অ্যাস্টেরয়েড-সমূহ বিপদ।

 


আদি অন্তহীন মহাবিশ্বের এক ক্ষুদ্র অংশ আমাদের সৌরজগৎ। আর সৌরজগতের গুরুত্বপূর্ন সদস্যরা হল গ্রহ, যাদের একমাত্র পৃথিবীতে রয়েছে প্রানের অস্তিত্ব। তবে শুধু গ্রহই নয়, রয়েছে উপগ্রহ, ধূমকেতু, মহাজাগতিক ধুলিকনা, সেই সঙ্গে রয়েছে অ্যাস্টেরয়েড বা প্ল্যানেটয়েড। অ্যাস্টেরয়েড এর কথা সম্ভবত সর্বপ্রথম উল্লেখ করেছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী বোড। তিনি গ্রহদের আপাত দূরত্ব নির্ণয়র মান তৈরী করতে গিয়ে বলেছিলেন যে, মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যে ফাকটা অত্যন্ত বেশী। ওখানে নিশ্চয় কোন জ্যোতিষ্ক থাকে। মহাকাশ বিজ্ঞানে এই তথ্যকে বলা হয় Bodes Law । সর্বপ্রথম ইতালির বিজ্ঞানী পিয়াৎসি ১৮৮১ সালে দূরবীনে একটা চলমান জ্যোতিষ্ক আকাশে দেখতে পান। প্রথমে ধূমকেতুর মতো মনে হলেও পরে তিনি বুঝতে পারেন এটি কোন ধূমকেতু নয় বরং ছোট্ট একটি গ্রহ । তিনি সেটির নাম দেন সিরিজ। 


পিয়াৎসির এই পর্যবেক্ষন মহাকাশবিদ্ দের ধাঁধায় ফেলে দিল। মূলত ইউরোপীয় গবেষকরা সিরিজ কে  পর্যবেক্ষন করার জন্য বিভিন্ন স্থানের টেলিস্কোপকে মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝে তাক করে রইলেন। এরই মধ্যে পিয়াৎসি "সিরিজের” ব্যাস নির্নয় করলেন ৪৮০ মাইল যা অন্যান্য গ্রহদের সতুলনায় অনেকটাই কম। যাই হোক ইউরোপীয় ওই মহাকাশ গবেষকদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল না বরং ছ'বছরের মধ্যে সেখান থেকেও আবিষ্কার হল আর  ও তিনটি গ্রহ যাদের আকার সিরিজের থেকে অনেক কম।  এদের নাম রাখা হল- প্যালাস, জুনো, ভেস্তা।এরা প্রায় গোলাকার হলেও দু'প্রান্ত ক্রমশ সংকীর্ন অনেকটা সুপারির মত। পরবর্তী কালে নভোবীক্ষন যন্ত্রের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আজ পর্যন্ত প্রায় নয় হাজার ছোট গ্রহ বা অ্যাস্টেরয়েড পর্যবেক্ষন করা গেছে। উন্নত মানের নভোবীক্ষন যন্ত্রেও এদের ছোট্ট আলোক বিন্দুর ন্যায় দেখা যায়। তবে “ভেস্তা' কে খালিচোখেও দেখা যায়। সম্ভবত “ভেস্তাই হলো বৃহত্তম এবং উজ্জ্বলতম অ্যাস্টেরয়েড। এর ভর সকল অ্যাস্টেরয়েড এর এক তৃতীয়াংশ।  


অ্যাস্টেরয়েড গুলি মূলত একটি বেল্ট বরাবর অবস্থান করে। বেল্ট কেন অ্যাস্টেরয়েড এর অরবিট বলা যেতে পারে। একটি বেল্টে কয়েক বিলিয়ন অ্যাস্টেরয়েড  থাকতে পারে। প্রতিটি অ্যাস্টেরয়েড নিজস্ব ছন্দে সূর্যকে প্রদক্ষিন করতে থাকে। এদের গতির অভিমুখ এবং ঘূর্ণনের প্রকৃতি গ্রহগুলির অনুরূপ। অ্যাস্টেরয়েড এর প্রধান বেল্ট টির দূরত্ব সূর্যথেকে ২৫৪ মিলিয়ন কিমি - ৫৯৮ মিলিয়ন কিমি। পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের আ্যাস্টেরয়েড হল আ্যাপোলো, আ্যামার এবং এথেন গ্রুপের অ্যাস্টেরয়েড।এথেন গ্রুপের অ্যাস্টেরয়েড পৃথিবীর অরবিট এ অবস্থান করে। স্টেরয়েড পৃথিবীর অরবিট কে ছেদ করে অবস্থান করে। অ্যাস্টেরয়েড গুলিকে উপাদানের ভিত্তিতে তিনটি অংশে ভাগ করা করা যায় - পাথর নির্মিত, ধাতু নির্মিত এবং পাথর ও ধাতু মিশ্রনে নির্মিত। Gaspra হল প্রথম পরিলক্ষিত এবং পাথর দ্বারা নির্মিত আ্যাস্টেরয়েড যা ১৯৯১ সালে গ্যালিলিও স্পেস প্রোবে প্রথম পরিলক্ষিত হয়েছিল। এটি প্রায় ১৯ কিমি লম্বা এবং প্রতি ৩.৩ বছরে এটি সূযকে প্রদক্ষিন করে। পরবর্তীতে এরোস, হিডালগো, আইকেরাস, হার্মিজ প্রভৃতি আ্যাস্টেরয়েডও এই প্রোব দ্বারা পরিলক্ষিত হয়েছিল। |

আধুনিক মহাকাশ গবেষকদের ধারনা সূদুর অতীতে অজানা কোন মাঝারি আকৃতির গ্রহ ছিল এ স্থানে।কোন ধূমকেতুর নিউক্লিয়াস বা উল্কাপাতের আঘাতে সেই গ্রহ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। পূর্বের গ্রহের প্রতি সূর্য মহাকর্ষ  বলের  টান থাকার ন্য টুকরো গুলি ছিটকে যেতে পারেনি। অনেক বিজ্ঞানীর মতে বৃহস্পতি গ্রহের তীব্র অভিকর্ষ এর ন্য গ্রহ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং কিছু টুকরো বৃহস্পতিতে পরে। বাকি টুকরো গুলি হয়ে যায় আজকের অ্যাস্টেরয়েড।অ্যাস্টেরয়েড শুধু মহাকাশেের ক্ষুদ্র জ্যোতিষ্কই নয় বরং এটি একটি সম্ভাব্য বিপর্যয়ের সমাহার। এরূপ  হাজার হাজার  অ্যাস্টেরয়েড এর ব্যাসার্ধ ৫০০ মিটার এর কম। ফলে অনেক সময়  এরা পৃথিবীর টানে পৃথিবীর দিকে চলে আসে এবং পৃথিবীর তলে আছড়ে পড়ে। বায়ুমন্ডলের মধ্যে দিয়ে আসার সময় অনেকটা পুড়ে গেলেও অবশিষ্ট অংশ পৃথিবীতে আঘাত করলে তার সংঘর্ষের  মাত্ররা ১০ টি হাইড্রোজেন  বোমার সমান। এর ফলে শুধু পরিবেশের ভারসাম্যই বিনষ্ট হবে না,

 বায়ুমণ্ডলের চাপ বেড়ে যাবে, সমুদ্রস্রোত এর গতিপথ পরিবর্তিত হবে। উত্তর মেরুতে এরূপ হলে বড় বড় হিমবাহ গলে সমুদ্রতলের উচ্চতা অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে। এ আশঙ্কা নিছক কাল্পনিক নয়, কারন অনেক বিবর্তন বিদের মতে প্রায় ছয়-সাত কোটি বছর আগে জুরাসিক যুগে ইউকাটান অঞ্চলে এরূপ আ্যাস্টেরয়েড পতনের ফলেই পৃথিবী থেকে ডাইনোসর ও সমকালীন অতিকায় জীবেরা হারিয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয় ১৯০৮ সালে সাইবেরিয়াতে তাঙ্গুস্কা অঞ্চলে এরূপ একটি অ্যাস্টেরয়েডের পতন হয়েছিল । যা প্রায় ১০ কিমি ব্যাসের অঞ্চলকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল।গত দশকেও বৃহস্পতির বুকের উপর একটি বড় অ্যাস্টেরয়েডের পতন দেখে শিউরে উঠে ছিলেন পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা। এরূপ সংঘর্ষ পৃথিবীতে হলে পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য। তাই আমেরিকা, রাশিয়া, চীন সহ বেশ কয়টি দেশ ইন্টার কনট্রি ব্যালিস্টিক মিশাইল (ICBM) এর মাথায় হাইড্রোজেন বোমা চাপিয়ে আকাশের দিকে তাক করে রেখেছে।যদি কোন আ্যাস্টেরয়েড সীমা (range) এর মধ্যে এসে পড়ে,তবে তাকে আকাশেই নষ্ট করে দেওয়া হবে। কিন্তু প্রকৃতির এই শক্তিকে মানুষের প্রযুক্তি কতখানি রুখতে পারবে তার জবাব হয়তো অদূর ভবিষ্যতই দেবে।




Comments

Popular posts from this blog

কৃষিক্ষেত্রে শৈবালের ভূমিকা